খুলনা, বাংলাদেশ: বাংলাদেশে কি খুব শিগগিরই এক ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানতে চলেছে? সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘন ঘন ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প এবং ভূতাত্ত্বিক গবেষণার ফল এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ভূতাত্ত্বিক ও গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে কল্পনাতীত।

কেন এই আশঙ্কা? বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থানই মূল কারণ
বিশেষজ্ঞরা এই আশঙ্কার পেছনে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থানকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশ মূলত ভারতীয় এবং ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই সুবিশাল প্লেটগুলো একে অপরের দিকে অবিরাম সরে আসছে এবং পরস্পরের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এর ফলে ভূ-অভ্যন্তরে বিশাল পরিমাণে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে।
বিশেষ করে, বার্মিজ প্লেট পশ্চিম দিকে এবং ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে। এই প্লেটগুলোর সংঘর্ষস্থল, যা সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চল বরাবর চলে গেছে, দীর্ঘদিন ধরে শক্তি সঞ্চয় করে রেখেছে। ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, গত ৮০০ থেকে ১০০০ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে জমে থাকা শক্তি বের হয়নি। সাধারণত এই ধরনের প্লেটের সংযোগস্থলে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যার পরিণতি হয় মারাত্মক।
এছাড়াও, বাংলাদেশের ভেতরে এবং আশেপাশে বেশ কিছু সক্রিয় চ্যুতি (fault line) রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- Advertisement -
- ডাউকি চ্যুতি: বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত বরাবর অবস্থিত।
- মধুপুর চ্যুতি: ঢাকার উত্তরে টাঙ্গাইল অঞ্চলে এর অবস্থান।
- সাগাইং ফল্ট: মিয়ানমারে অবস্থিত এই ফল্ট লাইনটিও বাংলাদেশে শক্তিশালী কম্পন সৃষ্টি করতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে ছোট ছোট ভূমিকম্পের সংখ্যা বৃদ্ধিকেও বিশেষজ্ঞরা বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন। ২০১৭ সালে যেখানে ২৮টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছিল, ২০২৩ সালে তা বেড়ে ৪১টি এবং গত বছর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৩টিতে, যা আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি: এক ভয়াবহ চিত্র!
যদি ৭ বা তার বেশি মাত্রার কোনো ভূমিকম্প বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকায় আঘাত হানে, তাহলে পরিস্থিতি কী হতে পারে? গবেষকদের পূর্বাভাস রীতিমতো উদ্বেগজনক। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যদি রাজধানীতে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তাহলে প্রায় ৮ লাখ ৬৪ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে, যা মোট ভবনের ৪০%।
দিনের বেলায় এমন ভূমিকম্প হলে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার এবং রাতের বেলায় হলে ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ক্ষয়ক্ষতির পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হবে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা ভবন। ঢাকার পুরনো অংশ তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী মাটির ওপর গড়ে উঠলেও, সম্প্রসারিত নতুন এলাকাগুলো, বিশেষ করে ভরাট করা জলাভূমির ওপর তৈরি, দুর্বল মাটির ওপর অবস্থিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কের মতো বা তার চেয়েও বেশি মাত্রার ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশে হতে পারে।
কিসের ভিত্তিতে এই পূর্বাভাস?
গবেষকরা তাদের এই আশঙ্কার পেছনে একাধিক সুনির্দিষ্ট কারণ দেখাচ্ছেন:
- টেকটোনিক প্লেটের গতিবিধি: ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে নিরন্তর চাপ সৃষ্টি এবং শক্তি সঞ্চয়ের বিষয়টি উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
- ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের রেকর্ড: বিগত ২৫০ বছরে বাংলাদেশে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পগুলোর বিশদ নথি পর্যালোচনা করা হয়েছে। ১৭৬২ সালের গ্রেট আরাকান ভূমিকম্প (৮.৫ মাত্রা) এবং ১৮৯৭ সালের গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্প (৮.০-৮.৭ মাত্রা) এর মতো বড় ঘটনাগুলো এখানে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
- ফল্ট লাইনগুলোর বিশ্লেষণ: সক্রিয় চ্যুতিগুলোতে (যেমন ডাউকি ফল্ট, মধুপুর ফল্ট) জমে থাকা শক্তির পরিমাণ এবং সেগুলোর ভূতাত্ত্বিক চরিত্র বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
- মাটির গঠন ও নগরায়ন: বিশেষ করে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মাটির দুর্বলতা এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে।
- সাম্প্রতিক ছোট ভূমিকম্পের প্রবণতা: ঘন ঘন ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলোকে একটি বড় ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। যদিও ভূমিকম্প কখন হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়, তবে পূর্বপ্রস্তুতি ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপরই এখন নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ ক্ষয়ক্ষতি কতটা কমানো যায়।

আপনার মতামত কী? এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের কতটা প্রস্তুত থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন?